বাঙালি বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগ
ইয়াহিয়া নয়ন
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভ্রান্ত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা। অতঃপর বাঙালি জাতির উপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, নির্যাতন, চরম অবেহলা ও দুঃশাসনে নিষ্পেষিত বাংলার জনগণের মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ। জন্মলগ্নে এই সংগঠনের নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার কেএম দাস লেনে অবস্থিত ঐতিহাসিক ‘রোজ গার্ডেন’ প্রাঙ্গণে জননেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারি মুসলিম লীগের প্রগতিশীল কর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সংগঠনটির প্রথম কমিটিতে মওলানা ভাসানী সভাপতি ও শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং জেলে থাকা অবস্থায় যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, শোষণমুক্ত সাম্যের সমাজ নির্মাণের আদর্শ এবং একটি উন্নত সমৃদ্ধ আধুনিক, প্রগতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দর্শনের ভিত্তি রচনা করে আওয়ামী লীগ। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে অসাম্প্রদায়িক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শুধু এ দেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠনই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারাও।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস একসূত্রে গাঁথা। ১৯৪৮ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সূচিত ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে গণজাগরণে পরিণত হয়। অব্যাহত রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার তরুণ সংগ্রামী জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান সেই সময়ে কারান্তরালে থেকেও ভাষা আন্দোলনে প্রেরণাদাতার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের বিজয়ের পটভূমিতে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়। তারপরও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থেকে দূরে রাখা হয়। নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ সরকার নিশ্চিত করে এক মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ।
আওয়ামী লীগের উদ্যোগেই মাতৃভাষা বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার আনুষ্ঠানিক মর্যাদা লাভ করে। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হয় জাতীয় ছুটির দিন- ‘শহীদ দিবস’। আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ প্রায় সম্পন্ন হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি।
মাত্র ২০ মাসের রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেয়ে চরম খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ থেকে বাঙালি জাতিকে রক্ষা করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার যে সফলতা অর্জন করে তাতে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বহু গুণ বেড়ে যায়। সে সময় মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে জনগণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
এরপর আইয়ুব খানের এক দশকের স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলন, ’৬২ ও ’৬৪-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ, ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৬-দফাভিত্তিক ’৭০-এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” খ্যাত কালজয়ী ভাষণ। পরবর্তীতে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। একাত্তরের ২৫ শে মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার পর ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবশেষে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আসতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। আদর্শবাদী, উদারনৈতিক এই রাজনৈতিক দলটির অস্তিত্ব বিনাশের চেষ্টাও হয়েছে। দলের ভেতরের কোন্দলও অনেক সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে। কিন্তু আলোর পথযাত্রী আওয়ামী লীগ সব বাধা-বিপত্তি মাড়িয়ে এগিয়ে গেছে।
১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইলের সন্তোষে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়। ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ দলের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করলে আওয়ামী লীগে দ্বিতীয়বারের মতো বিভক্তি দেখা যায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচন শুধু বাঙালির জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল না, আওয়ামী লীগের জন্যও একটি ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ ছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো ছিল ছয় দফা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে দেশের শত্রুরা সপরিবারে হত্যা করলে আওয়ামী লীগ আবার অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের এক বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে প্রবাসে নির্বাসন জীবনযাপনকারী শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতভাবে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সেই বছর ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশের এক ক্রান্তিকালে দেশে ফেরেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পায়। খুব কম দেশেই একটি দল ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে ক্ষমতায় ফিরতে সক্ষম হয়েছে।
‘আওয়াম’ শব্দের অর্থ জনগণ আর লীগ অর্থ দল বা গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগের অর্থ জনগণের দল বা গোষ্ঠী। অর্থাৎ জনগণের দল। জনগণের জন্য, জনগণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জনগণের এই দলটির প্রতি জনগণের আস্থা আছে। সেই জন-আস্থার প্রতিদান হিসেবে জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে আরো সক্রিয় ভূমিকা নিক আওয়ামী লীগ। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমুন্নত রাখুক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
বাঙালি জাতির মুক্তির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে জন্ম নেওয়া উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকে বেশির ভাগ সময়ই গেছে লড়াই-সংগ্রামে। সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির অর্জন অনেক।
তবে টানা চার বার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ দৃশ্যত এখনই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দেশে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থীর বোঝা। পাহাড়ে জঙ্গি তৎপরতা। বিদেশী নানা চাপ। ভোটাধিকার নিয়ে নানা নেতিবাচক সমালোচনা। রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভয়াকন দুর্নীতি। বিদেশি বিরিয়োগে ভাটা। বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চহার। সরকারকে চাপে রেখেছে। দুর্নীতি রোধ আর নিত্যপণ্যের দাম কমাতে আওয়ামী সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ।
তবে দল হিসেবে আওয়ামীলীগ বারবার হোঁচট খেয়ে দলটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন যতটা শক্তিশালী, তা যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য ঈর্ষণীয়। উপমহাদেশের রাজনীতিতে গত ৬ দশকেরও বেশি সময় ধরে অবিভাজ্য ও অবিচ্ছেদ্য স্বত্ব হিসেবে নিজেদের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগ। এ দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা প্রত্যুজ্জ্বল। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। তবে ষড়যন্ত্রের মধ্যেই আওয়ামী লীগ বারবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে ।
একজন আদর্শ রাজনীতিবিদের যে সকল বৈশিষ্ট্য ও গুনাবলী থাকা দরকার তা প্রায় সম্পূর্ণই শেখ হাসিনার মধ্যে বিদ্যমান। প্রথমত তিনি একজন ফুলটাইম রাজনীতিবিদ। রাজনীতি এবং দেশ যার ২৪ ঘন্টা ধ্যান জ্ঞান। এটা অবশ্য উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবও ছিলেন তাই। উপমহাদেশ তো বটেই পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন রাজনীতিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দুজনই সমগ্র জীবন দেশ ও রাজনীতির জন্য উৎসর্গ করেছেন। রাজনীতির মাঠে নিজেদেরকে কখনো ফাঁকি দেননি। দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণেই সমগ্র জীবন রাজনীতি করেছেন ও করে যাচ্ছেন।